লোডশেডিং ও তাপপ্রবাহ: কৃষিতে বাড়ছে আশঙ্কা

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: সারাদেশে বিদ্যুৎ থাকছে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে বন্দর-শহর, বাসা-বাড়ি, হাটবাজার, শপিংমল কিংবা অফিস-আদালত সবখানেই চলছে লোডশেডিং। তবে আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে কৃষিবিভাগ।

একদিকে লোডশেডিং, অন্যদিকে খরায় পুড়ছে কৃষি জমি। সারাদেশে লোডশেডিংয়ের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে দেশের কৃষক। অন্যদিকে ডিজেলের দাম বাড়ায় শ্যালো মেশিনে সেচ দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চাষিরা। সেচ নিয়ে ব্যাপক দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।

তীব্র তাপদাহে ঘন ঘন লোডশেডিং এবং সেচ কাজে পানির সংকটে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে খেটে খাওয়া মানুষসহ কেউই ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। তীব্র খরায় পুড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত উপজেলা।

প্রচণ্ড গরমে মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে অস্থিরতা। রোজগারের আশায় গরম উপেক্ষা করেই তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় মটর স্থাপন করায় রিং কুয়াগুলোয় পানি শুকিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। অপরদিক ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে ঠিকমতো সেচ কাজ পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ফলে অনেক এলাকায় সেচ সংকটে আউশ ও আমন ধান উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। এতে ধান উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।

খরার কারণে বাড়তি সেচ দিতে হচ্ছে। এতে আউশ ও আমন উৎপাদন ঠিক রাখতে পারবেন কি না তা নিয়েও চিন্তিত তারা। কৃষকরা জানান, এই খরা আরও অব্যাহত থাকলে ধানের উৎপাদন কম হতে পারে। লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের দেশে অগভীর হাজার হাজার ডিপ টিউবওয়েল চলছে; সেটা অবিরাম গতিতে চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

ফসলের গুণমান এবং পরিমাণ- প্রভাবিত হওয়ার কারণে ফসলে পানি দেওয়ার জন্য সেচের ওপর নির্ভরশীল উৎপাদনকারীদেরও নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করছে। লোডশেডিংয়ের প্রভাব কিছু প্রাথমিক উৎপাদকদের ওপর মারাত্মক হতে পারে এবং এমনকি কৃষিকাজ বন্ধ করে দিতে পারেন কৃষকরা।

অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে সেচপাম্প বন্ধ থাকছে। ক্ষেতের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই সময় জমিতে সেচ দিতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ক্লাইমেট নলেজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রার ব্যাপ্তি হলো, ১৫ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে মৃদু দাবদাহ বলে ধরা হয়। ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে ধরা হয় মাঝারি দাবদাহ। আর ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে ধরা হয় তীব্র দাবদাহ চলছে।

ঢাকায় বর্তমানে তীব্র দাবদাহের কাছাকাছি তাপমাত্রা রয়েছে। দাবদাহ প্রাণ-বৈচিত্র্য তথা কৃষির জন্য ভালো কিছু নয়। এর ফলে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। অতিগরমে অসুস্থ হয়ে পৃথিবী জুড়ে প্রতিবছর মারা যান হাজারও মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী জুড়েই আবহাওয়া অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। তারপরও আগের মতোই জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছি আমরা, উজাড় করছি বন, প্লাস্টিক ব্যবহার করছি প্রতিদিন। যার ফলে কৃষি পড়ছে মারাত্মক হুমকিতে।

কৃষিতে একটা ইতিবাচক কিছু দেখা দিলে সাথে আরও তিনটা নেতিবাচক খবর এসে সামনে পড়ে। ফসল ভালো হলো তো বন্যা এসে ভাসিয়ে নিল। কখনো অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হলো। কিন্তু এবার নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর তা হলো তীব্র গরম বা দাবদাহ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে, এই তাপপ্রবাহ বজায় থাকতে পারে আরও কিছুদিন।

প্রতি বছরই গ্রীষ্মের শুরুতে তীব্র দাবদাহ বয়ে যায় সারাদেশের ওপর। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সামনের দিনগুলোয় প্রায় প্রতি বছরই এমন দীর্ঘায়িত খরা, দাবদাহ ও অনাবৃষ্টির মোকাবিলা করতে হবে বলে বিভিন্ন সময়ে বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসে উঠে এসেছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তায় আগামীতে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘বাংলাদেশ সেক্টর অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’ শিরোনামে মার্চে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই জিডিপির ২ শতাংশ হারাবে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে ফসলের রোগবালাই এবং পোকামাকড়ের আক্রমণও। এমনকি মোটামুটি সহনীয় মাত্রার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে ধান উৎপাদন কমবে ১৭ শতাংশ। গরমের কারণে এর হার কমবে ৬১ শতাংশ।

ফসলহানির প্রধানতম কারণ হবে দীর্ঘায়িত দাবদাহ ও খরা। পরিবেশে বাড়তি তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে কৃষি খাতে উৎপাদনের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে শ্রমিকের কর্মদক্ষতা। এছাড়া দেশের মৎস্যসম্পদের ওপরে খরা, লবণাক্ততা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব সংকট আরও জটিল করে তুলবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও উন্নয়ন। সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে খাদ্যনিরাপত্তা, জীবিকা ও জীবন।

দেশের ফসল উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা ক্ষতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগেই দিনে ও রাতের তাপমাত্রায় ব্যাপক পার্থক্য থাকায় বিভিন্ন জেলায় ধানে ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ দেখা দেয়। এতে ফসলের বেশ কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।

দৈনিক তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়ায় ধানে ‘হিট শক’র আশঙ্কা দেখছেন ধান গবেষকেরা। বোরো ধান ও সবজি খেতে প্রতিদিনই সেচ দিতে হচ্ছে। এতে একদিকে কৃষকের সেচ ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে চাপ পড়েছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর।

ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। এছাড়া ফল ও সবজির চারাকে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য সেচ নিশ্চিত করতে হবে। খরা দীর্ঘায়িত হওয়ায় এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিনে দিনে আরও নেমে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

আমরা যেহেতু গরম কমাতে পারছি না, সেহেতু গরমসহিষ্ণু কৃষি ব্যবস্থার দিকে আমাদের যেতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণসহিষ্ণু জাতগুলো দিয়ে চাষাবাদ করতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলে আম-লিচুসহ বিভিন্ন ফসল চাষে গুরুত্ব দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনে ওপর কৃষি নির্ভর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া অসহিষ্ণু হবে। বৃষ্টির সময়-পরিবর্তিত হবে। লবণাক্ততা বাড়বে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো ফসলের উপকারি পোকামাকড়ের অস্তিত্বকেও এখন হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এই সমস্যা আরও প্রকট করে তুলেছে কৃষিতে নির্বিচারে রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগ।

বাংলাদেশে যা তাপমাত্রা, তারচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে, কারণ আর্দ্রতা অনেক কমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ফলে এগুলোর প্রভাবও এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে, যার ব্যবস্থাপনাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশ এককভাবে আসলে কিছু করতে পারবে না। বাংলাদেশের পক্ষে আগামীদিনে এককভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।

সমীরণ বিশ্বাস, কৃষিবিদ।

সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।